সভার শুরুতে কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান ছাত্র-শ্রমিক-জনতার মহান আত্বত্যাগের মাধ্যমে বৈষম্যহীন, মর্যাদাপূর্ণ ও সমতার বাংলাদেশ গড়ার যে আকাংক্ষা ও স্বপ্ন তৈরি হয়েছে তা উল্লেখ করেন। শ্রমিকের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশন সকল অংশীজনের সাথে মতবিনিময় এর অংশ হিসেবে খুলনার স্কপভুক্ত সংগঠন ও অন্যান্য জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানান। বাংলাদেশে শ্রম খাতের ব্যপ্তি অনেক বড় উল্লেখ করে তিনি বলেন কমিশন সকল শ্রেণির ও মানুষের প্রস্তাব ও মতামতের প্রতিফলন রিপোর্টে দেখতে চান। এজন্য কমিশন যতবেশি সম্ভব শ্রমিকের কথা শুনতে চান। বাংলাদেশে বৈষম্যের শিকড় এতো গভীর যে স্থায়ী-অস্থায়ী, শিল্পে-শিল্পে, গৃহে-গৃহে, দক্ষ-অদক্ষ এমনকি আউটসোর্সিং ক্ষেত্রে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। কমিশন সকলের সহযোগিতায় এমন একটি সুপারিশ করবে যাতে কর্মক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে, শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে এবং ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা হচ্ছে তা তুলে ধরা যায়। ০২। সম্মানিত সদস্য এডভোকেট এ কে এম নাসিম বলেন এই কমিশন শ্রমিকের অধিকারের চিত্র তুলে ধরবে, শ্রম খাতের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ ও তা থেকে উত্তোরণের উপায় খুজে বের করার চেষ্টা করবে। অনেক মানুষ আছেন যাদেরকে শ্রম আইনের বাইরে রাখা হয়েছে যেমনঃপ্রশাসনিক, তদারকি ও তত্ত্বাবধানমূলক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি সহ শ্রম আইন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ সীমিত করা হয়েছে। কমিশন চেষ্টা করবে কীভাবে তাদের আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা যায় এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। একই সাথে কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে শিল্পের স্বার্থকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ০৩। সম্মানিত সদস্য জনাব রাজেকুজ্জামান রতন বলেন বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত ও তালিকাহীন প্রায় ৪০৭ ধরণের কাজ রয়েছে। এসব শ্রমিকের শ্রমের উপর দেশের জি ডি পি প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। সাংবিধানিকভাবে কাজ অধিকার, সম্মান ও মর্যাদার হলেও শ্রমিকরা আজ বঞ্চিত ও নীপিড়িত। কমিশন যে সুপারিশ প্রদান করবে তা বর্তমান ও আগামীর রাজনৈতিক সরকারের জন্য দিক নির্দেশনা হিসেবে থাকবে। ০৪। জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন ০৫ই আগস্ট পরবর্তী যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তা হলো অর্থনীতির সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দেয়া। এ কাজে শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশের যে বিরাট ভুমিকা তা অবশ্যই সফল করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশ যৌক্তিক , মানবিক ও সুখকর হবে এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। ০৫। খুলনা হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়ন এর প্রতিনিধি জনাব শফিকুর রহমান বলেন খুলনা একসময়ের শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত হলেও আজ এক মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে। অনেক শ্রমিক অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করছেন, অনেকে অসুস্থ হয়ে মৃত প্রায় আবার অনেকেই হতাশা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক শ্রম আইন দাবি করেন। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার আহ্ববান জানান। শ্রম আইন লংঘন করে হাতে ও মাথায় অতিরিক্ত ওজন বহন করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি ওজনসীমা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে আইন বাস্তবায়নের দাবি জানান। যেসব শ্রমিক হাট বাজারে মালামাল উঠানামা করে তাদের মৌলিক শ্রম অধিকার রক্ষার উপর জোর দেন। ০৬। জনাব আবু দাউদ, জাতীয়তাবাদী পাট শ্রমিক ইউনিয়ন বলেন ২৬ টি জাতীয় পাটকলের মধ্যে ০৫ টি পাটকলের শ্রমিকরা শ্রম আইন অনুযায়ী পাওনা পাননি। তারা মজুরি কমিশনের বকেয়া মজুরি থেকে বঞ্চিত। প্রায় ৮০০০ শ্রমিক বছরের পর বছর চাকুরিতে নিয়োজিত থাকলেও দৈনিক ভিত্তিক বিবেচনা করে তাদের বকেয়া ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করা হয় নি। করোনাকালীন কারখানা এক মাস ছাব্বিশ দিন বন্ধ থাকলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মজুরি পেলেও তাদের মজুরি দেয়া হয় নি। তিনি বলেন জুটমিলের শ্রমিকদের দৈনিকভিত্তিক দেখিয়ে তাদের শ্রম অধিকার হতে যে বৈষম্য করা হয়েছে তা রোধকল্পে শ্রম আইনে শ্রমিকের শ্রেণিবিভাগে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা দরকার। ০৭। জনাব আব্দুর রাজ্জাক তালুকদার বলেন জুটমিলে ট্রেড ইউনিয়নকে অকার্যকর করতে আদালতে মামলা দায়ের করে বন্ধ করার অপচেষ্টা চলছে। তিনি শ্রমিকের পাওনা টাকা পরিশোধ করা, পাট সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের বিচার করা ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার আন্দোলন চালু রাখার দাবি জানান। ০৮। জনাব খান গোলাম রসুল, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন বলেন পাটশিল্পে ভারতকে অবৈধ সুযোগ দেয়ার জন্য বিগত সরকার কর্তৃক রাজনৈতিকভাবে এ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৯৩ টি পাটকলে প্রায় তিন লাখ শ্রমিক নিয়োজিত থাকলেও তারা শ্রম আইন অনুযায়ী ছুটি, গ্রাচ্যুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও মজুরিসহ অন্যান্য চাকুরিকালীন সুবিধাদি পান না। তিনি বলেন শ্রমিকের মজুরি কোনভাবেই বকেয়া রাখা যাবে না। এজন্য শ্রম পরিদর্শকদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে, পরিদর্শক কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে, বাজার দর অনুযায়ী শ্রমিকের মজুরিসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান করতে হবে। শিল্পের মালিক শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধ না করে বিদেশে পালালে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ০৯। জনাব আফজাল, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র,খুলনা অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, জাতীয় সর্বনিম্ন মজুরি বেসিক ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ ইত্যাদি বিষয়ে কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১০। মোসাঃ ডলি, বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশন বলেন খুলনায় নারীরা শিক্ষিত হয়েও কোন কাজ করবে সে সুযোগ কম। তিনি হতাশার সাথে বলেন শ্রমিকের কষ্ট দুঃখ কেউ বুঝে না। কাজের সুযোগ কম থাকায় নারীরা স্থানীয় কর্মসংস্থান না করতে পেরে বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছেন। এজন্য স্থানীয় চাহিদা নিরুপন করে কর্মমুখী প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেয়ার সুপারিশ করেন। ১১। দৌলতপুর জুট মিল বেলিং ইউনিয়ন এর সভাপতি বলেন তার মিলে ৪২ হাজার শ্রমিক থাকলেও ৬২০০ জনে পৌছেছে। এ শিল্পের মালিকরা সোনালী ব্যংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন নিয়ে অন্যান্য ব্যবসায় কাজে লাগান। লোনের আবেদন যাচাই বাছাই না করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে রাজনৈতিক চাপ ও কমিশনের লোভে অনুমোদন দেয়া হয়। ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন আবেদন করলে শ্রম অধিদপ্তর হতে মালিকের প্রত্যয়ন নিয়ে আসার জন্য বলা হয়। আইনে এ ধরণের বিধান না থাকলেও অবৈধ অজুহাতে আবেদন বাতিল করা হয়। শ্রমিকের বকেয়া মজুরি চাইলে তাদের নামে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে হয়রাণি করা হয়। ১২। জনাব উজ্জ্বল কুমার সাহা, সভাপতি, খুলনা সিটি কর্পোরেশন শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন শ্রম অধিদপ্তরকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান করার দাবি জানান যাতে এটি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। তিনি আউটসোর্সিং , মাস্টার রোল ও বহিরাগত শ্রমিক সিস্টেম বাতিলের সুপারিশ করেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি নীতিমালা রয়েছে মর্মে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উক্ত নীতিমালায় এক নাগাড়ে দশ বছর কাজ করলে সকল সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির উল্লেখ করা হয়েছে। ১৩। জনাব বাবুল খলিফা কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান, পর্যাপ্ত মজুরি, পেনশন সুবিধা, মালিকের খরচে চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ, মৃত্যুর ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, মালিকের ব্যর্থতায় সরকার কর্তৃক সকল চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানান। ১৪। জনাব রবিউল ইসলাম রবিন , শ্রমিক অধিকার পরিষদ জাতীয় ন্যুন্তম মজুরি, কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তালাভের নিশ্চয়তা, ট্রেড ইউনিয়নের দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন, শ্রম আইন প্রতিপালনে সরকারের যথাযথ তদারকি এবং শ্রমিকের জীবন বাচাতে রেশনিং সুবিধা চালু ইত্যাদি সুপারিশ করেন। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য শ্রমিক হাসপাতাল নির্মাণ ও শ্রমিকের সন্তানের বিনামূল্যে সুশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করেন। ১৫। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের খুলনা জেলা সভাপতি বলেন দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরিসহ খুলনার বন্ধ সকল কারখানা চালু করা, জাতীয় ন্যুন্তম মজুরি কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা, নারী-পুরুষ মজুরি বৈষম্য দূর করা, ব্যাটারিচালিত যানবাহন শ্রমিকের জীবিকা ও অধিকার রক্ষায় নীতিমালা প্রনয়ন করা, ক্ষেতমজুর-মাছের ঘেরে নিয়োজিত শ্রমিকের ন্যুনতম শ্রম অধিকার রক্ষা, পর্যটন শিল্পে শ্রম নীতিমালা এবং চিংড়ি শিল্পের নিয়োজিত শ্রমিক বিশেষ করে নারী শ্রমিকের অধিকার রক্ষার দাবি জানান। তিনি কমিশনের নিকট তার লিখিত সুপারিশ পেশ করবেন মর্মে জানান। ১৬। জনাব ফারহানা ইয়াসমিন জানান চিংড়ি শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক কোন নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র পান না, জরুরি প্রয়োজনে ছুটি প্রদান বা কর্মস্থল হতে বের হতে দেয়া হয় না, পর্যাপ্ত মজুরি পান না, ওভারটাইম প্রদান করা হয় না। তিনি শ্রমিকের ন্যুনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা , ১২ ঘন্টার পরিবর্তে ০৮ ঘন্টা কাজের সময় নিশ্চিত করা, নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা, আইন অনুযায়ী ছুটি ইত্যাদি অধিকার নিশ্চিতের দাবি জানান। কারখানায় অত্যধিক ঠান্দা পরিবেশে কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রদান করা, নিয়মিত মজুরি বৃদ্ধি, আইনগত দাবি জানালে মালিক কর্তৃক বে আইনি চাকরি থেকে বের করে দেয়ার ক্ষেত্রে সুরক্ষা, সুপারভাইজারসহ অন্যান্য ব্যক্তি কর্তৃক যৌন হয়রানিসহ নিপীড়ন হতে সুরক্ষার দাবি জানান। এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা জনাব শাহাদাত বলেন এসব কারখানায় মালিকের পকেটভুক্ত ইউনিয়ন তোইরি হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ১৭। কাজী শহিদুল ইসলাম , সাধারণ সম্পাদক, খুলনা মটর শ্রমিক ইউনিয়ন বলেন মোটর শ্রমিকরা চরম অবহেলার শিকার, মালিক-সরকার কেউ তাদের সহযোগিতা করে না, চাকরির নিরাপত্তা নেই, শিক্ষার ব্যবস্থা নেই, দুর্ঘটনার চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ এর ব্যবস্থা নেই। তিনি শ্রমিকদের এসব অধিকারসহ নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, রেশন সুবিধা এবং সড়ক ও মহাসড়কে গোসল ও বিশ্রামাগারের দাবি জানান। ১৮। লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি নদীর নাব্যতা রক্ষা, বিভিন্ন চ্যানেলে ড্রেজিং করা, নৌপথে নিরাপত্তা, বয়াবাতির ব্যবস্থা এবং শ্রমিকদের সার্ভিস বুক সংরক্ষণের দাবি জানান। ১৯। বিদ্যুৎ খাতের প্রতিনিধি বলেন এ খাতে নামমাত্র সংস্কার হয়েছে, ব্যাপক জনবল ঘাটতি হলেও শ্রমিক নিয়োগ খুব কম হচ্ছে, ব্যাপকভাবে আউটসোর্সিং নিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় জনগন কাংক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে ২৫ বছর চাকরি করার পর তাদের চাকরি কোম্পানিতে ন্যস্ত করে আইনানুগ পেনশন হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ খাতে সংস্কার করা হলেও শ্রমিকের অংশগ্রহণ ও মতামত নেয়া হচ্ছে না। ২০। জনাব শেখ মনিরুল ইসলাম, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিঃ বলেন তাদের সংস্থা কে কোম্পানিতে রুপান্তর করা হলে সকল কর্মকর্তা প্রেষণ ভাতা পেলেও শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। তিনি শ্রমিকদের প্রেষণ ভাতা প্রদানের দাবি করেন। তিনি নির্মাণ ও হ্যান্ডলিং শ্রমিকদের ঝুকিভাতা ও বীমা সুবিধার দাবি জানান। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের শ্রম অধিদপ্তরের আওতায় রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার সুপারিশ করেন। বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন দুর্নীতি ও মালিকের নিয়ন্ত্রণে হাইজ্যাক হতে রক্ষায় ট্রেড ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী না হলে সদস্য পদ বাতিল করা উচিত বলে মত দেন। ২১। খুলনা নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে জনাব ফকির আলী আহমেদ মিঠু বলেন এই খাতে ইলেক্ট্রিক,রাজমিস্ত্রি, সেনেটারি মিস্ত্রিসহ অনেকেই নিয়োজিত রয়েছে। তিনি বলেন শ্রমিক ঝুকিপূর্ণ কাজ যেনো পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সাথে করতে পারে, শ্রমিক অংগহানির ক্ষেত্রে যেনো পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পায় এবং মালিক কর্তৃক যেনো সকল সুবিধা প্রদান করা হয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানান। ২২। চাতাল সেক্টরের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি বলেন বাংলাদেশ শ্রম আইন ও তা বাস্তবায়নের জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থাকলেও আইনের বাস্তবায়ন নেই। এ শিল্পে ন্যুনতম মজুরি নেই, চুক্তিপত্র, নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র নেই, আট ঘন্টার স্থলে ১৬ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা হয়, মহিলা শ্রমিকের মজুরি কম, আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা নেই, প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা প্রদান করা হয় না, সাপ্তাহিক ও বার্ষিক ছুটি প্রাদান করা হয় না। তিনি এসব আইনি বিধান লংঘনের বিষয়ে সুরক্ষা দাবি করেন। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। আটো রাইচ মিল বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক নারী শ্রমিক চাকরি হারাচ্ছেন যাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। ২৩। মোঃ ইউসুফ, বন্দর ও লাইটারেজ শ্রমিকের পক্ষে একজন প্রতিনিধি জানান বন্দরে কোন চিকিৎসা ও হাসপাতাল নাই। তাদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র নিশ্চিত করেন। শ্রমিকের সকল সুবিধা নিশ্চিত করতে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করার দাবি জানান। সরকার, মালিক ও ফেডারেশনের মধ্যে চুক্তি হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয় না। তিনি লিখিত প্রস্তাব দিবেন মর্মে জানান। ২৪। অলিয়ার রহমান, গনসংহতি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন পাটকল শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি, হাজিরা বোনাস, বকেয়া পাওনা দাবি করেন। যেসব শ্রমিক শ্রমিক কলোনিতে কোনরুপ সুবিধা ছাড়াই চাপড়া ঘরে অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করছে তাদের বাড়িভাড়া ও যাতায়াত ভাতা কর্তন বন্ধ করার দাবি জানান। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন পাটকলে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, সরকারি মালিকানাধীন জুট মিল লিজ দেয়া বন্ধ করার উপর জোর দেন। ২৫। জনাব শামস, বি এল কলেজের ছাত্র ও রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলের শ্রমিক বলেন বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন ও বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। কারখানায় ৪ হাজারের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী ৪ বছরের বেশি সময় ধরে বেতনসহ সকল সুবিধা পাচ্ছেন যার পিছনে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা খরচ হলেও কোন শ্রমিককে মজুরি প্রদান করা হচ্ছে না। অল্প দামে ভারী মেশিনারি বিক্রয় করা সকল ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার দাবি জানান। তিনি কারখানা বন্ধ করার রীতি থেকে সরকারকে সরে আসা উচিত বলে জোর দেন। ২৬। জনাব আল আমিন শেখ শ্রম আইনের নানা অসংগতি ও ফাকফোকর দূর করে বৈষম্য দূর করার সুপারিশ করেন। স্থায়ী জাতীয় মজুরি কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেন। খুলনা-যশোর অঞ্চলের ০৯ টি রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল সরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু করার দাবি জানান। এ বিষয়ে মাননীয় চেয়ারম্যান, শ্রম সংস্কার কমিশন বলেন এ অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ব কারখানাগুলো কেন বন্ধ হলো, এগুলো চালু করতে কী করা যায়, লোকসান না করে কর্মসংস্থান রক্ষা করতে কী করা যায় এবং স্থানীয় পর্যায়ে সরকার কী কজ করলে কর্মসংস্থান বাড়বে এ বিষয়ে শ্রমিকনেতারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেন। ২৭। কোহিনুর আক্তার কণা, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট বলেন শ্রেণি বিভক্ত সমাজে রীতি নীতি সংস্কারের এমন নেতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে যে নারী প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে। তিনি বলেন সামাজিক পরিবর্তন, সমাজে নারীর অবস্থান পরিবর্তন দরকার। নারীকে নিজের অবস্থান উপলব্ধি করে নিজেকেই এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের পথ খুজতে হবে। এছাড়া তিনি গৃহ শ্রমিকের শ্রম অধিকার , মর্যাদা, নিরাপদ কর্ম্পরিবেশ, কর্মঘন্টা ও মজুরি রক্ষায় গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫ এর বাস্তবায়ন চান এবং তাদের শ্রম আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। তিনি বলেন পাটকলের অনেক নারী শ্রমিক আজ কাজ না পেয়ে গৃহশ্রমিকের কাজ করছেন। ২৮। জনাব খালেক, জাতীয় শ্রমিক জোট শ্রমিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে এমন সকল আইন বাতিলের দাবি জানান। আই এল ও কনভেনশন ১৮৯ ও ১৯০ সরকার কর্তৃক অনুসমর্থন করার সুপারিশ করেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসকিপ্সহন অনুযায়ী Jute Sector Adjustment Policy এর আওতায় ৩২ টি রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল ১ দিনে বন্ধ করা হয় যা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। তিনি বিদেশি সংস্থার এ ধরণের পরামর্শ নেয়া বন্ধ করা দরকার বলে উল্লেখ করেন। পাট শিল্প শতভাগ মূল্য সংযোজনকারী শিল্প হলেও এ শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। পাটজাত পণ্যের বহুমুখীকরণের অপার সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো হয়নি। ৩২ টি পণ্যের মোড়কীকরণের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক পাটপণ্য ব্যবহার আইন করা হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। জাতীয় ন্যুনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার যে প্রস্তাব এসেছে তা পুনর্মূল্যায়ণ করা দরকার বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন সরকার ১০০ কোটি টাকার liability নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো চালু করলে তা লাভজনক করা সম্ভব। ২৯। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, খুলনার সভাপতি জনাব সাহাদাত বলেন শ্রম আদালত এ মামলা দায়ের করে রায় পাওয়ার পর মালিকপক্ষ আবার আপিল করলে অর্থ ও সময় ব্যয় হয় ফলে শ্রমিক ন্যায়বিচার পান না। তিনি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সকল দপ্তরের যথাযথ দায়িত্ব পালনের উপর জোর দেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতাভুক্ত করা, স্থায়ীকাজে আউটসোর্সিং বন্ধ করতে হবে, আইনের ২৬ ধারা বাতিল করতে হবে, শ্রমিক তার স্বাধীনমতো ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে, জাতীয় ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণসহ আই এল ও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ এর সাথে সংগতি রেখে বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে। বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়ার প্রস্তাব করেন। এছাড়া ইজিবাইক শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান, মজুরি বকেয়া ও কম মজুরি প্রদান করায় যাতে শ্রম পরিদর্শক তাৎক্ষনিক জরিমানা করতে পারেন সেজন্য ক্ষমতা অর্পণ, রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে মধ্যস্বত্তভোগীদের দৌরাত্ব্য বন্ধে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে নিয়োগ বন্ধ করা, শ্রম আইন সংশোধন করে সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার চাকুরি বিধিমালা বা চাকুরির শর্তাবলি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মাধ্যমে অনুমোদন করার ব্যবস্থ্যা করার দাবি জানান। ৩০। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অধীন উপমহাপরিদর্শকের কার্যালয়, খুলনার সহকারী মহাপরিদর্শক জনাব শাহিনুর রহমান বলেন ঘেরে কর্মরত শ্রমিকের খাবার পানি, নারী ও পুরুষের আলাদা টয়লেট , নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন হতে শ্রমিকের আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্তি সহজবোধ্য করা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রত্যেক জেলায় অফিস স্থাপন করা, ডাইফ এর অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে দপ্তরের শীর্ষ পদ আই জি ও অতিরিক্ত আই জি পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি দাবি জানান। এছাড়া তিনি জানান অনেক পরিদর্শক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক চাপে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। পরিদর্শকের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের স্বার্থে টি এ বিল, যানবাহন সুবিধা ও রেশন সুবিধা প্রদানের অনুরোধ করেন। ৩১। সম্মানিত সদস্য জনাব রাজেকুজ্জামান রতন বলেন রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলের শ্রমিকের করুণ অবস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি বেসরকারি পাটকলের শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ২৫০ টাকা পেলে মাসিক আয় মাত্র ৭০০০ টাকা যা অত্যন্ত অমানবিক। তিনি ডাইফ কেনো তার সক্ষমতার সবটুকু প্রয়োগ করতে পারছে না তা বের করা দরকার বলে উল্লেখ করেন। লোনা পানির প্রভাবে অনেক নারী শ্রমিকের গর্ভপাত হচ্ছে এবং অনেক নারী শ্রমিক গর্ভধারণ করতে পারছেন না। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দেশের সাত কোটি ৩৭ লক্ষ শ্রমিকের অধিকার ও কল্যাণ নিয়ে কাজ করলেও তাদের জন্য মাত্র ৩৩ কোটি টাকার বাজেট যা অত্যন্ত অপ্রতুল। ৩২। মাননীয় চেয়ারম্যান, শ্রম সংস্কার কমিশন বলেন আজকের মতবিনিময় সভায় শ্রমিক নেতৃবৃন্দ খুলনা অঞ্চলের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান নিয়ে এবং পুরো অঞ্চলকে ধারণ করেন যা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। আলোচনা থেকে দেখা যায় পাটকল বন্ধ করে যেমন শ্রমিকের জীবন ও জীবিকা নিঃশেষ হয়েছে তেমনি বিদ্যমান যেসব শিল্প-কারখানা রয়েছে সেখানে শোভন কাজের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। আমাদের শ্রম খাতে জাতীয় কিছু থাকলেও অঞ্চলভিত্তিক অনেক সংকট রয়েছে। খুলনার শ্রম খাতের উন্নয়ন করে শিল্প ও কর্মসংস্থান সৃজন, এ অঞ্চলকে প্রাণচাঞ্চল্য করে তোলার জন্য গবেষক, মানবাধিকার কর্মী, ছাত্র, যুবক, শ্রমিক সংগঠন, সিভিল সোসাইটি কে নিয়ে খুলনা স্মারক প্রস্তুত করা দরকার এবং নাগরিকের এ দাবিকে জাতীয় ইস্যু করে তোলা দরকার। এ কমিশন যুক্তি ও তথ্য দিয়ে যে সুপারিশ করবে জাতীয় পর্যায়ে তার একটা আলাদা গুরুত্ব বহন করে। কমিশনের সুপারিশ তখনই কার্যকর হবে যখন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সবাই একতাবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে ছাত্র-যুবক-শ্রমিকের স্বপ্নের প্রতিফলন যেনো কমিশনের রিপোর্টে চলে আসে।